নারীরা শিক্ষায় এগিয়ে, কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে
বাংলাদেশের মেয়েরা শিক্ষাজীবনের শুরুতে যতটা আলো ছড়ান, শেষ দিকে গিয়ে নানা কারণে তারা ততটাই ম্রিয়মান হয়ে পড়েন। প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এগিয়ে থাকলেও উচ্চশিক্ষায় দেখা যায় উল্টো চিত্র। আর কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি আরও কম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২২ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৯২ দশমিক ২ শতাংশ মেয়ে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই হার ৯০ দমমিক ২ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিকে (১৫ থেকে ২৪ বছর) এই হার আরও বেশি। মাধ্যমিকের পর ৯৫ দশমিক ৮ শতাংশ মেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই হার ৯৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
জরিপে দেখা গেছে, মাধ্যমিকে মেয়েদের ভর্তির হার গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি। গ্রামঞ্চলে এই হার ৯০ দশমিক ২ শতাংশ; শহরে ৯৪ দশমিক ৯ শতাংশ। গ্রামের মেয়েদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৯৫ দশমিক ৯ শতাংশ। শহরে কিছুটা বেশি; ৯৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জরিপে উঠে এসেছে, এই পর্যায়ে গিয়ে মেয়েরা নানা কারণে ছিটকে পড়েন। স্নাতক বা পিএইচডির মতো ডিগ্রির ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। অনেক মেয়ে ভর্তি হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া সম্পন্ন করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে বিয়ে হয়ে যাওয়া, সন্তান লালন-পালন, মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় পরিবারের অনীহা, চাকরি করতে অভিভাবকের অসম্মতিকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
জরিপে দেখা গেছে, ২৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার হার ৭১ দশমিক ৩ শতাংশ; ছেলেদের ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ। ৭ বছর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত সময়ে মেয়েদের গড় স্বাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ছেলেদের ৭৭ দশমিক ৪ শতাংশ।
কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে মেয়েরা
শিক্ষায় এগিয়ে থাকলেও কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। মাত্র ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ মেয়ে কর্মক্ষেত্রে যান; ছেলেদের ক্ষেত্রে এই হার ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ। ৮১ দশমিক ১ শতাংশ মেয়ে গৃহিনী হয়ে যান।
ঝুঁকিপূর্ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হওয়া এলাকা নিয়ে করা এক পরিসংখ্যানে সম্প্রতি ইউনিসেফ দেখিয়েছে, যারা কৃষি, ব্যবসা কিংবা দিনমজুরের কাজে নিয়োজিত, তাদের মধ্যে ১০ দশমিক ৬০ শতাংশ নারী। পুরুষ আছে ৮৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাত্র ৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ নারী কৃষি জমির মালিক। বাকি জমির মালিক পুরুষ। অন্যদিকে গৃহস্থালির কাজের ৯৮ দশমিক ৫৪ শতাংশই নারীদের করতে হয়।
বাল্যবিয়ের হিড়িক
করোনাকালে সর্বোচ্চ বাল্য বিয়ে ও পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে মেয়েদের। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, দারিদ্রতা, পুষ্টিজনিত সমস্যাকেই বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। গ্রামঞ্চলে প্রতি এক হাজারে ১৪৬ জনের বাল্যবিয়ে হয়; শহরে হয় ৮১ দশমিক ৪ জনের।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬ মেয়ের বাল্যবিয়ে হয়েছে। অর্থাৎ দৈনিক ৬৫টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি হয়েছে রাজশাহীতে; ৩০ দশমিক ১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞের মত
ইউনিসেফের শিক্ষাবিশেষজ্ঞ ইকবাল হোসেন বলেন, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে বাল্যবিয়ে অনেকাংশেই কমে যাবে। ইউনিসেফ এখন সে লক্ষ্যেই কাজ করছে। প্রাথমিকে মেয়েদের অংশগ্রহণের যে হার আছে, সেটা মাধ্যমিক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে ইউনিসেফ। দুটি পর্যায়ে ইউনিসেফ কাজ করছে। একটি স্কুলে সরাসারি শেখা; অন্যটি ঝরে পড়া মেয়েদের শিক্ষন কর্মসূচি। ছয় মাসের কর্মসূচির আওতায় মৌলিক শিক্ষাসহ নানা প্রশিক্ষণ ও অভিভাবকদের সচেতনার কাজ করছে ইউনিসেফ।
ডিএফ/কেএ